গত বছরের জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও বার্ন বিশেষজ্ঞ ডা. সামন্ত লাল সেন প্রকাশ্যে আর দেখা যাচ্ছেন না। তিনি স্বেচ্ছায় প্রকাশ থেকে দূরে সরে গেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তিনি বর্তমানে দেশে আছেন, নাকি বিদেশে অবস্থান করছেন—এ নিয়ে রয়েছে নানা গুঞ্জন। তবে তার ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র দাবি করেছে, ডা. সামন্ত লাল এখনো দেশেই রয়েছেন, তবে নিরাপত্তাজনিত কারণে নিজেকে আড়ালে রেখেছেন।
বিগত সরকারের আমলে অধিকাংশ মন্ত্রী-এমপির বিরুদ্ধে দুর্নীতির গুরুতর অভিযোগ থাকলেও ডা. সামন্ত লাল সেনের বিরুদ্ধে তেমন অভিযোগ ওঠেনি। তিনি দলমত নির্বিশেষে সবার কাছে অগ্নিদগ্ধ মানুষের জন্য ‘লড়াকু যোদ্ধা’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রূপসা থেকে পাটুরিয়া—দেশের যে কোনো স্থানে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেই তিনি বিচলিত হয়ে পড়তেন। ঘটনাস্থলে উপস্থিত চিকিৎসকদের কাছে অগ্নিকাণ্ডে কতজন হতাহত হয়েছে, তাদের শরীরে কত শতাংশ দগ্ধ হয়েছে, তাদের গোল্ডেন আওয়ারের মধ্যে সুচিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটের দ্রুত পৌঁছানোর তাগিদ দিতেন।
কারণ, তিনি খুব ভালো করেই জানতেন, অগ্নিদগ্ধ ব্যক্তির প্রথম এক ঘণ্টার মধ্যে ফ্লুইড লস (তরল পদার্থের ঘাটতি) দ্রুত শুরু হয়, যা শকে পরিণত হতে পারে, ইনহেলেশন ইনজুরি (ধোঁয়া কণ্ঠনালীতে প্রবেশ) ফুসফুসকে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, ব্যথা বা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা দরকার, দগ্ধ টিস্যু যত দ্রুত ঠান্ডা করা যায় তত বেশি সুস্থ টিস্যু বাঁচানো সম্ভব হয়।
দেশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নানান সময়ে দেখা গেছে, বিভিন্ন বিভাগীয় শহর কিংবা জেলা থেকে রোগী পৌঁছানোর আগে তিনি বার্ন ইউনিটে পৌঁছে রোগীদের হাসপাতালে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা শুরু করার পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে রাখতেন। চিকিৎসক জীবনের শুরু থেকে তিনি অগ্নিদগ্ধ রোগীদের সুচিকিৎসায় ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভায় টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী হিসেবে ৭৫ বছর বয়সেও স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন তিনি।
সোমবার (২১ জুলাই) ঢাকার উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবনে বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর আছড়ে পড়ে। এ ঘটনায় মারাত্মক অগ্নিদগ্ধ হয়ে এরই মধ্যে ২০ জনের মর্মান্তিক মৃত্যুর তথ্য জানিয়েছে আইএসপিআর।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন শিক্ষার্থীসহ অন্তত ১০ জন। তাদের শরীরের ৯৫ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। অগ্নিদগ্ধ হয়ে বার্ন ইউনিটের ওয়ার্ডের বিছানায় শুয়ে পোড়ার যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন অনেকে।
বিমান দুর্ঘটনায় অগ্নিদগ্ধদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবেও খোঁজখবর নিচ্ছেন। প্রয়োজনে উন্নত চিকিৎসার জন্য দগ্ধদের বিদেশে পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল।
তবে বিমান বিধ্বস্তে হতাহতের ঘটনায় স্বজনদের আহাজারিতে ঢাকার আকাশ যখন ভারী হয়ে উঠেছে তখন অনেকের মুখে উচ্চারিত হচ্ছে ডা. সামন্ত লাল সেনের নাম। অগ্নিদগ্ধদের সুচিকিৎসা নিশ্চিতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চললেও অনেকেই এই কঠিন সময়ে দেশের অন্যতম বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক বিশেষজ্ঞ ডা. সেনকে স্মরণ করছেন। অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এই স্বনামধন্য চিকিৎসকের অভাব অনুভব করার কথা জানাচ্ছেন।
বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় একের পর এক যখন অগ্নিদগ্ধদের বিভিন্ন হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছিল তখন সেখানে উদ্বিগ্ন স্বজনরা সুচিকিৎসা চেয়ে হাউমাউ করে কাঁদছিলেন। তাদের অনেকে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ডা. সামন্ত লাল সেনের কথা স্মরণ করছিলেন। অনেকেই বলছিলেন, পরিস্থিতি (রাজনৈতিক) অনুকূলে থাকলে তিনি হয়তো এতক্ষণে নিজেই হাসপাতালে ছুটে আসতেন।
ডা. সামন্ত লাল সেনের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র গণমাধ্যমেক জানিয়েছে, আত্মগোপনে থাকলেও তিনি দেশেই আছেন। মাসখানেক আগেও তার সঙ্গে কথা হয়েছে। সূত্রটি ডা. সেনের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে যোগাযোগের পরামর্শ দেন। তবে এ প্রতিবেদক একাধিকবার তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও ডা. সেন সাড়া দেননি।
সোমবার দুপুর ১টা ৬ মিনিটে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর এফ-৭ বিজিআই প্রশিক্ষণ বিমানটি উড্ডয়ন করে। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই বিমানটি বিধ্বস্ত হয়ে উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের হায়দার হল নামের একটি ভবনের ক্যানটিনের ছাদে গিয়ে আছড়ে পড়ে।
রাতে আইএসপিআর এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহত বেড়ে ২১ জনে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন আরও ১৭০ জন। তাদের অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক।