চালকের চোখে ঘুম ছিল। বিমানবন্দর থেকে ফেরার পথে গাড়িটি কুমিল্লা হয়ে ফেনীতে প্রবেশ করলে একবার দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পায়। তখন থেকেই চালককে ঘুম নিয়ে একাধিকবার সতর্ক করা হয়, কিন্তু সে কারও কথা শোনেনি। শেষ পর্যন্ত ঘুমে ঢুলে পড়লে হঠাৎ ঝাঁকুনিতে জেগে ওঠে চালক, তখনই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাড়িটি লক্ষ্মীপুর-ঢাকা আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশের খালে পড়ে যায়। ঘটনার পরপরই সে গাড়ির দরজার কাঁচ খুলে পালিয়ে যায়। পানিতে ডুবে মারা যান গাড়িতে থাকা ৪ নারী ও ৩ শিশু। প্রাণে বেঁচে যান প্রবাসীসহ আরও ৫ জন।
এভাবেই কথাগুলো বলেছেন বেঁচে ফেরা প্রবাসী বাহার উদ্দিন, তার বাবা আব্দুর রহিম ও শ্বশুর ইস্কান্দার মির্জা। তাদের সবার একই দাবি, চালকের ঘুমের কারণেই পরিবারের ৭ জন চিরতরে ঘুমিয়ে পড়েছেন।
বুধবার (৬ আগস্ট) দুপুরে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার উত্তর জয়পুর ইউনিয়নের চৌপল্লী বাজার এলাকার কাশারি বাড়িতে গেলে ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়। এর আগে ভোরে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার আলাইয়াপুর ইউনিয়নের পূর্ব বাজার এলাকায় লক্ষ্মীপুর-ঢাকা আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশে খালে পড়ে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
সরেজমিনে কাশারি বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, আশপাশসহ দূর-দূরান্তের মানুষ বাড়িতে ভিড় জমিয়েছেন। একটি পুরনো টিনশেড ঘরের সামনের কক্ষেই চৌকিতে শোয়ানো ছিল শিশু মীম আক্তার (২), রেশমা আক্তার (৯) ও লামিয়া ইসলামের (৮) মরদেহ। সেখানে তাদেরকে ঘিরে কান্না করছে স্বজনরা। এরপর একটি ভবনে ঢুকতেই সামনের কক্ষে মেঝেতে দেখা যায় ৪ জন নারীর মরদেহ ঢেকে রাখা হয়েছে। তারা হলেন, কবিতা আক্তার (২৪), মুরশিদা বেগম (৫০), ফয়জুন নেছা (৭০) ও লাবনী আক্তার (২৫)। তাদের মরদেহ দাফন করতে কেউ বাঁশ কাটছে, কেউ আবার কবর খুঁড়ছে। একটি মিনি পিকআপে করে আনা হয়েছে খাঁটিয়া। বিকেলে বাদ আছর নামাজের জানাজা শেষে নিহতদের মরদেহ পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
নিহতদের মধ্যে বাহারের স্ত্রী কবিতা, মেয়ে মীম, মা মুরশিদা, নানী ফয়জুন নেছা, ভাবি লাবনী, ভাতিজি রেশমা ও লামিয়া। চোখের সামনে প্রিয়জনদের মৃত্যু দেখে শোকে কাতর হয়ে রয়েছেন প্রবাসী বাহার, আব্দুর রহিম ও ইস্কান্দার মীর্জা। এখন তাদের পাগলপ্রায় অবস্থা। একেকবার একেকজনকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন তারা। পরিবারের সদস্যদের মৃত্যু কোনোভাবে তারা মানতে পারছেন না। আশপাশের মানুষজন বাড়িতে ভিড় জমালেও তাদেরকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না কেউ।
বেঁচে ফেরা বাহার, আব্দুর রহিম ও ইস্কান্দার মির্জা জানায়, আড়াই বছর পর ওমান থেকে দেশে আসেন প্রবাসী বাহার। তাকে আনতে মঙ্গলবার (৫ আগস্ট) রাতে পরিবারের ১১ সদস্য মাইক্রোবাসযোগে রাজধানীতে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যায়। সেখান থেকে বাহারকে নিয়ে ফেরার পথে ঘটনাস্থল পৌঁছলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাড়িটি প্রায় ৩০ মিটার গভীর খালে পড়ে। তবে তাৎক্ষণিক গাড়িটি ডুবে যায়নি। নৌকার মতো ভেসে ছিল। ধীরে ধীরে গাড়িটি ডুবে যায়। এসময় গাড়ির লক খুলে দিতে বললেও চালক রাসেল তা করেনি। সে নিজে গাড়ির দরজার কাঁচ নামিয়ে বের হয়ে গেছে। গাড়িতে আটকে থাকা কাউকেই উদ্ধারের চেষ্টা না করে সে পালিয়ে গেছে। একপর্যায়ে গাড়ি থেকে প্রবাসী বাহার, তার বাবা আব্দুর রহিম, শ্বশুর ইস্কান্দার মীর্জা, ভাবি সুইটি আক্তার ও শ্যালক রিয়াজ হোসেন বের হয়ে আসে।
প্রবাসী বাহার উদ্দিন বলেন, আমার স্ত্রীকে চেষ্টা করেছি বের করার জন্য, কিন্তু সে মেয়েকে ছাড়া বের হয়নি। মাকেও বের করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি, তিনি নানিকে ছাড়া বের হননি। অনেক কষ্টে এক ভাবিকে বের করেছি। অন্যদেরকে চেষ্টা করেও বের করতে পারিনি। একে একে সবাই পানিতে ডুবে মারা গেল। চালককে বার বার বলেছি গাড়ি থামিয়ে একটু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য, কিন্তু নিল না। তার ঘুম আমার পুরো পরিবারকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। সে আমাদের ডুবিয়ে রেখে পালিয়ে গেছে। আমার মেয়েকে বিমানবন্দরে প্রথম কোলে নিয়ে আদর করেছি। একটিবারের জন্যও বুঝতে পারিনি এটিই প্রথম এবং শেষ কোলে নেওয়া ছিল।
বেঁচে ফেরা ইস্কান্দার মির্জা বলেন, পথে অনেকবার আমি চালককে সজাগ করেছি। তাকে বলেছি, তুমি বসো, প্রয়োজনে এক-দেড় ঘণ্টা পরে যাব। আমিও চালক ছিলাম, আমি জানি। এজন্য গাড়ি থামিয়ে চা পান করানো হয়েছে। এরমধ্যেই হঠাৎ সে লাফ দিয়ে উঠে গাড়ি চালু করে। এরপরও তাকে বাধা দিয়েছি। কিন্তু সবাই আমাকে ডেকে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়েছে। এরপরও আমি তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে এসেছি। কিন্তু ঘটনাস্থল এসে সে ঘুমের মধ্যে ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে। তাকে ব্রেক ধরতেও বলা হয়েছে। কিন্তু পারেনি, গাড়ি গিয়ে পানিতে পড়ে।
বাহারের জেঠা আবুল কাশেম বলেন, ঘটনাস্থল থেকে আমাদের বাড়ির দূরত্ব প্রায় ১০ কিলোমিটার। এখানে আসতে তাদের ১০-১৫ মিনিট সময় লাগতো। কিন্তু বাড়িতে তাদের জীবিত আসা হয়নি। এটি মর্মান্তিক ঘটনা। এমন ঘটনা কখনো কল্পনাও করিনি।
স্থানীয় বাসিন্দা শাহজাহান বলেন, আমরা অত্যন্ত ভারাক্রান্ত। এরকম দুঃখের ঘটনা আমরা আর দেখিনি। চালকের অবহেলার কারণে এ ঘটনাটি ঘটেছে। সকল চালক যেন গাড়ি চালানোর সময় সতর্কতা অবলম্বন করেন। আধাঘণ্টা এক ঘণ্টা দেরি হলেও পেসেঞ্জারদেরকে বলে চালকদের বিশ্রাম নেওয়া জরুরি।
