এক বছর আগে, ২০২৪ সালের ১ জুলাই। দিনটি ছিল সোমবার। তবে বাংলাদেশের ইতিহাসে তা শুধু একটি দিন নয়—তা ছিল নতুন ইতিহাসের সূচনা। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহালের প্রতিবাদে সারাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর হয়ে উঠেছিল প্রতিবাদের মঞ্চ। ছাত্রদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে রাজপথে নেমে এসেছিলেন হাজারো কণ্ঠস্বর। তখন কেউ বুঝে উঠতে পারেননি, এই আন্দোলনই ১৬ বছরের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পতনের দিকে নিয়ে যাবে।

কোটা বিরোধী আন্দোলন থেকে গণঅভ্যুত্থান

এই আন্দোলনের পেছনে ছিল হাইকোর্টের একটি রায়। ২০২৪ সালের ৫ জুন, বিচারপতি কেএম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের বেঞ্চ প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা করেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে শিক্ষার্থীরা। ৩০ জুন পর্যন্ত সরকারের কোনো প্রতিক্রিয়া না আসায় ১ জুলাই শুরু হয় সর্বাত্মক আন্দোলন।

ঢাকা, জগন্নাথ, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সর্বত্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার থেকে শুরু হয়ে রাজু ভাস্কর্যে শেষ হয় মিছিল। ঘোষিত হয় তিন দিনের কর্মসূচি। আন্দোলনের মুখ হয়ে ওঠেন নাহিদ ইসলাম। ঘোষণা আসে—দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান ও পরীক্ষা বন্ধ থাকবে।

উত্তাল ছিল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো

  • ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: কয়েক শতাধিক শিক্ষার্থী বিক্ষোভে অংশ নেন। শহীদ মিনার, টিএসসি, ভিসি চত্বর ঘুরে রাজু ভাস্কর্যে সমাবেশে মিলিত হন। স্লোগান ছিল— “কোটা না মেধা, মেধা চাই”, “জেগেছে রে ছাত্রসমাজ”।
  • জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়: ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানারে শিক্ষার্থীরা ৪ দফা দাবি তুলে ধরেন।
  • জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়: ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করেন ছাত্ররা।
  • রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়: দ্বিতীয় দিনের মতো মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা।
  • বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়: ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে বিক্ষোভ করে অনগ্রসর গোষ্ঠী ছাড়া সব কোটা বাতিলের দাবি জানায়।
  • চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়: শহীদ মিনার চত্বরে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা।

আন্দোলন যখন মাথাচাড়া দিচ্ছিল, তখন আওয়ামী লীগ ব্যস্ত ছিল বিএনপিকে ঘিরে রাজনৈতিক বক্তব্যে। ১ জুলাই তেজগাঁওয়ে আওয়ামী লীগের এক সভায় সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, “বিএনপির নেতাদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে।” অথচ পরবর্তী সময়, সেই কাদের নিজেই দেশত্যাগ করেন এবং ভারতে আশ্রয় নেন।

৫ আগস্ট: পতনের দিন

এই আন্দোলনের মাত্র ৩৫ দিনের মাথায়, ৫ আগস্ট ২০২৪—আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়। সভাপতি দেশত্যাগ করেন। নেতাকর্মীরা আত্মগোপনে যান। কিন্তু ইতিহাসে লেখা হয়ে যায়, সেই আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ১ জুলাই।

এক বছর পর—বর্ষপূর্তিতে নানা আয়োজন

অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মসূচি

জুলাই শহীদদের স্মরণে ৩৬ দিনব্যাপী কর্মসূচি হাতে নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এর মধ্যে রয়েছে—ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে দোয়া, পোস্টারিং, স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ, আলোচনাসভা, ডকুমেন্টারি প্রদর্শনী এবং ৫ আগস্ট বিজয় মিছিল।

এনসিপির কর্মসূচি

জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ১ জুলাই থেকে ‘জুলাই পদযাত্রা’ শিরোনামে দেশের প্রতিটি জেলায় পদযাত্রার ঘোষণা দিয়েছে। শহীদদের কবর জিয়ারত, পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং গণসংযোগ কর্মসূচি পালন করবে তারা।

বিএনপির ৩৬ দিনের কর্মসূচি

বিএনপি ঘোষণা করেছে—আলোচনাসভা, মৌন মিছিল, সেমিনার, রক্তদান কর্মসূচি, ফুটবল টুর্নামেন্ট, পথনাটক, সচেতনতামূলক কার্যক্রমসহ ২২টি ভিন্নধর্মী আয়োজনের মাধ্যমে বর্ষপূর্তি উদযাপন করা হবে। ১ জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে আলোচনা সভায় ভার্চুয়ালি অংশ নেবেন তারেক রহমান।

গণঅধিকার পরিষদ

‘কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে রাষ্ট্র সংস্কার’ শীর্ষক আলোচনা সভার মাধ্যমে মাসব্যাপী কর্মসূচি পালন করছে গণঅধিকার পরিষদ।

শিবিরের কর্মসূচি

‘জুলাই জাগরণ নব উদ্যমে বিনির্মাণ’ প্রতিপাদ্যে ৩৬ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে ছাত্রশিবির। এর মধ্যে রয়েছে—সেমিনার, কনফারেন্স, শহীদদের কবর জিয়ারত, ডকুমেন্টারি প্রদর্শনী, সাহিত্য প্রকাশনা, গ্রাফিতি অঙ্কন ও পডকাস্ট।

আপ বাংলাদেশের উদ্যোগ

শহীদদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, গুম-খুনের বিচার, সুচিকিৎসার দাবি এবং জুলাই ঘোষণাপত্র বাস্তবায়নে ১ থেকে ৩৬ জুলাই পর্যন্ত দেশব্যাপী গণসংযোগ চালাচ্ছে ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশ (আপ বাংলাদেশ)।


সর্বশেষ

১ জুলাই আজ আর শুধুই একটি তারিখ নয়। এটি এখন এক প্রতীক—আন্দোলনের, প্রতিবাদের, পরিবর্তনের। ছাত্রদের সেই স্লোগান—“কোটা না মেধা”—আজ শুধু ক্যাম্পাসে নয়, ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে। আন্দোলনের সেই আগুন থেকে জন্ম নিয়েছে নতুন ইতিহাস, আর সেই ইতিহাসের প্রথম পাতায় লেখা রয়েছে ১ জুলাইয়ের নাম।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version