হজ ইসলামের পাঁচটি মূল স্তম্ভের একটি। এটি কেবল বাহ্যিক আনুষ্ঠানিকতা নয়—বরং এক অন্তর্নিহিত আত্মিক উন্নয়ন ও আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণের মাধ্যম। পবিত্র বায়তুল্লাহ ও রাসুল (সা.)-এর রওজা মুবারক জিয়ারতের বাসনা প্রতিটি মুমিন হৃদয়ে লালিত হয়। কিন্তু আল্লাহ তাআলা বাহ্যিকতা নয়, অন্তরের তাকওয়া ও নিষ্ঠা মূল্যায়ন করেন। হজ তখনই পরিপূর্ণ হয়, যখন তা হয় ‘অন্তরের হজ’।

পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, “আসলে তাদের হৃদয় এ কুরআন থেকে উদাসীন। আর এ ছাড়া তাদের আরও অনেক মন্দ কর্ম রয়েছে, যা তারা করে চলেছে” (সূরা আল মোমিনুন, আয়াত: ৬৩)। যারা সত্যিকারের মুমিন, তাদের অন্তর থাকে পবিত্র। তাদের সম্পর্কেই আল্লাহ বলেন, “হে শান্তিপ্রাপ্ত আত্মা! তুমি তোমার প্রভুর সন্তুষ্টি নিয়ে ফিরে এসো… আমার জান্নাতে প্রবেশ করো” (সূরা ফজর, আয়াত: ২৭–৩০)।

বাহ্যিকতা নয়, অন্তরের তাকওয়া প্রয়োজন

আল্লাহ বলেন, “তোমাদের কুরবানির পশুর গোশত ও রক্ত কখনো আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, বরং তার কাছে তোমাদের আল্লাহভীতিই পৌঁছে” (সূরা হজ, আয়াত: ৩৭)। এই আয়াত আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, বাহ্যিক কাজের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো অন্তরের পবিত্রতা ও আল্লাহভীতি। হজের উদ্দেশ্য যদি হয় লোক দেখানো, সম্মান অর্জন বা ব্যবসায়িক পরিচিতি বাড়ানো, তবে তা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।

অন্তর বিশুদ্ধ না হলে হজ বৃথা

হজে যাওয়ার আগে আত্মবিশ্লেষণ করা আবশ্যক: আমার আত্মা কি সেই পবিত্র স্থান তাওয়াফ করার যোগ্য? হালাল রিজিক গ্রহণ না করে, প্রতিবেশীর অভাবকে উপেক্ষা করে প্রতি বছর হজ করাও আত্মিক উন্নয়ন নয়। হাদিসে এসেছে, “আল্লাহ তোমাদের চেহারা ও দেহের প্রতি দৃষ্টি দেন না, বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও কর্মের দিকে তাকান” (মুসলিম)।

অনেকে মনে করেন, হজ করে এলেই গুনাহ মাফ হয়ে যায়, কিন্তু তারা হজের মূল দর্শন ভুলে যান। নবী (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হজ পালন করে এবং কোনো অশালীন কথা ও পাপ কাজ করে না, সে যেন সদ্যজাত শিশুর ন্যায় নিষ্পাপ হয়ে ফিরে আসে” (বুখারি ও মুসলিম)। তবে প্রশ্ন হলো, হজ শেষে আমরা কতজন এই নিষ্পাপ অবস্থাকে ধরে রাখতে পারি?

হজ হোক আত্মিক শুদ্ধির মাধ্যম

সত্যিকারের হজ তাদেরই হয়, যারা হজের পর বদলে যান—ব্যক্তিত্বে, কর্মে, চিন্তায়। যারা আল্লাহর ভালোবাসায় আত্মাকে সমর্পণ করে, মানবতার কল্যাণে নিজেদের নিয়োজিত করেন, দয়ালু হন, পাপ থেকে ফিরে আসেন। যারা নিজেদের রিজিক হালাল করে তোলেন, যাকাত দেন, ফিতরা দেন, প্রতিবেশীর হক আদায় করেন।

আত্মবিশ্লেষণই হজের পূর্বশর্ত

হজে যাওয়ার আগে আত্মাকে জিজ্ঞেস করা উচিত: “আমি কি হালাল উপার্জনে হজ করছি? আমার আত্মা কি হজের উপযুক্ত?” যদি তা না হয়, তবে বাহ্যিক হজে কোনো উপকার নেই। আল্লাহর সঙ্গে প্রেমময় সম্পর্ক তৈরির জন্য চাই তওবা, তাকওয়া, ত্যাগ, আন্তরিকতা ও মানবিকতা।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে অন্তরের হজ করার তৌফিক দিন। বাহ্যিক আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং পবিত্র অন্তর নিয়ে যেন আমরা হজ সম্পন্ন করি এবং হজ আমাদের জীবনে এক সত্যিকার পরিবর্তনের সূচনা করে—এই প্রার্থনাই হোক আমাদের।
আমিন।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version