বলিউডের ইতিহাসে ‘খলনায়িকা’র চরিত্র বললেই যে নামটি মাথায় আসে, তিনি ললিতা পাওয়ার। পর্দায় তাকে যতই কঠিন, নিষ্ঠুর বা চতুর চরিত্রে দেখা যাক, বাস্তব জীবনটা ছিল একবারে বিপরীত। কোমল মনের এই অভিনেত্রীকে জীবনজুড়ে পিছু ছুটেছে দুর্ভাগ্য, বিশ্বাসঘাতকতা আর একের পর এক ট্র্যাজেডি।
চলচ্চিত্রে নায়িকা হিসেবে উত্থান ঘটেছিল ললিতার।
নির্বাক চলচ্চিত্র থেকে টকিজ—সব জায়গাতেই তিনি সফলভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করছিলেন, তবে ১৯৪২ সালে ঘটে যায় ভয়াবহ এক ঘটনা। বিখ্যাত অভিনেতা ও পরিচালক ভগবান দাদার সঙ্গে একটি ছবির শুটিং চলছিল। দৃশ্য অনুযায়ী তাকে ললিতার গালে চড় মারতে হবে, সিনেমায় যা সাধারণত নকল করে দেখানো হয়। কিন্তু ওই দিন অভিনেতা সত্যিই জোরে চড় মারেন।
সেই চড়ে এতটাই আঘাত লাগে যে ললিতা তখনই অজ্ঞান হয়ে পড়েন। মুখের স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বাঁ চোখের একটি শিরা ফেটে যায় আর তার মুখ বেঁকে যায় স্থায়ীভাবে। সেই থেকেই তৈরি হয় চোখের স্থায়ী সমস্যা। ওই ঘটনায় কার্যত বেকার হয়ে পড়েন অভিনেত্রী।
ললিতা পরে দূরদর্শনের এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘দুই বছর আমি একেবারে কাজহীন ছিলাম। আমাকে বহু ছবি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল।’ নায়িকা হিসেবে ক্যারিয়ার যে শেষ, তা তিনি বুঝতে পারেন, কিন্তু হার মানেননি।
স্বাস্থ্যের কিছুটা উন্নতি হলে, ললিতা ছোট-বড় চরিত্রে অভিনয় শুরু করেন। চরিত্র যে বড়, তা নয়—কিন্তু দৃশ্য যত সংক্ষিপ্তই হোক ললিতা নিজের ছাপ রাখার চেষ্টা করেছেন।
রাজকাপুরের ‘শ্রী ৪২০’-তে ছোট চরিত্রে অভিনয় করে তিনি আবার আলোচনায় আসেন। পরবর্তী সময়ে ‘রামায়ণ’-এ মন্থরা চরিত্রে তাঁর অভিনয় আজও দর্শকের স্মৃতিতে অমলিন।
পর্দার সাফল্যের আড়ালে ব্যক্তিগত জীবনও ছিল নানা ঝড়ে টালমাটাল। ১৯৩০-এর দশকে তিনি বিয়ে করেন চলচ্চিত্র প্রযোজক গণপত্রাও পাওয়ারকে। কাজের সুবাদেই তাঁদের ভালোবাসা তৈরি হয়েছিল।
তবে কয়েক বছরের মধ্যেই ললিতা জানতে পারেন, স্বামী তাঁরই বোনের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছেন। বিয়ের ইতি টেনে বেরিয়ে আসেন তিনি। পরবর্তী সময় তিনি প্রযোজক রাজপ্রকাশ গুপ্তকে বিয়ে করেন। এই সংসারে তাঁদের একটি পুত্রসন্তানের জন্ম হয়—জয়।
আশির দশকে ‘রামায়ণ’-এ অভিনয়ের পর তাঁর ক্যারিয়ারে নতুন উত্থান ঘটে। কিন্তু নব্বইয়ের দশকে তিনি মুখের ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। চিকিৎসার জন্য পরিবারসহ পুনেতে চলে যান। ১৯৯৮ সালে, ৮২ বছর বয়সে হঠাৎ মারা যান ললিতা। দুর্ভাগ্যের শেষ অধ্যায়টি আরো হৃদয়বিদারক—মৃত্যুর সময় স্বামী ও ছেলে কেউই শহরে ছিলেন না, ফলে দুই দিন ধরে তাঁর মৃত্যু টেরই জানা যায়নি। ছেলে বারবার যোগাযোগ না পেয়ে পরিচিত কাউকে পাঠালে গিয়ে দেখা যায়—ললিতা আর নেই।
কেন আজও তিনি স্মরণীয়
ললিতা পাওয়ার প্রমাণ করে গেছেন অভিনয়ের শক্তি শুধু মুখের সৌন্দর্য বা নায়িকা ইমেজে নয়; চরিত্র, গভীরতা আর পর্দার উপস্থিতিতেই একজন শিল্পী অমর হয়ে ওঠেন। জীবনের কঠিনতম আঘাতগুলোর মধ্যেও তিনি অভিনয় চালিয়ে গেছেন আর বলিউডের ইতিহাসে তৈরি করেছেন এক অমোচনীয় ছাপ।
