বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার সাবেক উপাচার্য নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) তাকে আদালতে হাজির করে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করে দুদক।
আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার মেট্রোপলিটন সিনিয়র স্পেশাল জজ মো. জাকির হোসেন গালিবের আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
শুনানিতে নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ আদালতকে বলেন, ‘সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি আমার কাছে অন্যায় আবদার করতেন। আমি এর প্রতিবাদ করি, সংবাদ সম্মেলন করি। এতে রাগান্বিত হয়ে তিনি আমার বিরুদ্ধে অপবাদ ছড়িয়েছেন।’
এদিন বিকেল ৪টার দিকে নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহকে দুদকের সাদা মাইক্রোবাসে করে আদালতে আনা হয়। পরে তাকে সরাসরি এজলাসে হাজির করা হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা, দুদকের সহকারী পরিচালক মিনহজ বিন ইসলাম, তাকে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন। এরপর বিকেল ৪টা ১৬ মিনিটে বিচারক এজলাসে ওঠেন। এ সময় কলিমউল্লাহকে এজলাসে বসার বেঞ্চ থেকে তুলে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়।
এরপর ৪টা ২২ মিনিটে শুনানি শুরু হয়। নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ’র পক্ষে তার আইনজীবী শাহনাজ সুমি জামিন চেয়ে শুনানি করেন। তিনি বলেন, ‘নিয়মবর্হিভূতভাবে তিনি কিছু করেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবকিছুতে ভিসির একার বিষয় থাকে না। চাইলেই ২ বা ৪ জন টাকা আত্মসাৎ করে নিতে পারে না। সবকিছু ডকুমেন্টেড ব্যাপার। তিনি কিছু আত্মসাৎ করেননি। বিধি, নিয়ম-কানুনের সঙ্গে সবকিছু করেছেন। তিনি বয়স্ক, অসুস্থ মানুষ। তার জামিনের প্রার্থনা করছি।’
দুদকের পক্ষে প্রসিকিউটর দেলোয়ার জাহান রুমি জামিনের বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, ‘দুদকের মামলা হঠাৎ করে হয় না। দীর্ঘ সময় অনুসন্ধান হয়। আসামিও সে বিষয়ে অবগত থাকেন। তিনি মামলার অভিযোগ তুলে ধরে জামিনের বিরোধিতা করেন।’
এরপর বিচারকের প্রশ্নের মুখোমুখি হন নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ। কত সালে নিয়োগ পান জানতে চান বিচারক। তিনি বলেন, ‘আমাকে প্রথমে বিইউপিতে কো-উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর তৎকালীন সরকার একদিনের জন্য আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানান্তরিত করে। পরবর্তী সময়ে আমাকে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।’
এরপর বিচারক জিজ্ঞেস করেন, ‘২০১৭ সালে?’ জবাবে তিনি বলেন, ‘হ্যা।’ বিচারক জানতে চান, ‘ক্যাম্পাস কোথায়?’ কলিমউল্লাহ বলেন, ‘রংপুরে।’
পরে বিচারক বলেন, ‘আপনি তো ফুল টাইম ঢাকায় থাকতেন।’ কলিমউল্লাহ বলেন, ‘না স্যার। আমি ঢাকায় থাকলেও ওইখানে আমার বাসা ছিল। এর জন্য বেতনের ৪০ শতাংশ কেটে নিতো।’ তখন বিচারক বলেন, ‘চাকরিকালে আপনি তো ১৩৫২ দিনের মধ্যে ১১১৫ দিনই ঢাকায় ছিলেন।’
এর জবাবে তিনি বলেন, ‘তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি অন্যায় আবদার করতেন। তার কারণে ক্যাম্পাসে যেতাম না। আমি তার এসব আবদারের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করি। তিনি রাগান্বিত হয়ে আমার বিরুদ্ধে অপবাদ ছড়িয়েছেন। প্রতিদিন ১৭ থেকে ১৮ ঘণ্টা ভার্সিটির স্বার্থে কাজ করেছি। মুক্তিযুদ্ধের পর এটাই প্রথম, কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি শিক্ষামন্ত্রীকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। এ কারণে দীপু মনি আমার বিরুদ্ধে অপবাদ ছড়িয়েছেন।’
তখন বিচারক বলেন, ‘আপনি ও আপনার মা কোনও এক নিয়োগ বোর্ডে একই সঙ্গে ছিলেন?’ তখন তিনি বলেন, ‘তিনি (তার মা) মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের ডিজি ছিলেন। তিনি একজন সার্টিফায়েড সসিওলজিস্ট। এজন্য তাকে সরকার নিয়োগ বোর্ডের সদস্য করেন।’
পাল্টা প্রশ্নে বিচারক জানতে চান, ‘আপনি কি একই সঙ্গে ভিসি, বিভাগীয় প্রধান ও ডিন ছিলেন?’ জবাবে কলিমউল্লাহ বলেন, ‘আমিই প্রথম নয়। আগের ভিসির ধারাবাহিকতা রক্ষায় এসব দায়িত্বে ছিলাম। উপযুক্ত লোক না থাকায় বিশেষ পরিস্থিতিতে এ দায়িত্বে থাকতে হয়েছে।’
বিচারক জানতে চান, ‘চার বছরে উন্নয়ন খাতে কোনও টাকা পেয়েছেন?’ তখন কলিমউল্লাহ বলেন, ‘আমার আগের ভিসি নুর নবীর সময় ৯৯ কোটি টাকার কাজ চলমান ছিল। আমি দায়িত্ব নিয়ে কাজ চলমান রেখেছি। আর নকশা পরিবর্তনের অভিযোগ আগের ভিসির বিরুদ্ধে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটাই প্রকল্প বিশেষ উন্নয়ন প্রকল্প। আমি এসে নিয়োগ বাণিজ্য, চাকরি বাণিজ্য বন্ধ করে দিয়েছি।’
তখন বিচারক বলেন, ‘নিয়োগ বাণিজ্য, চাকরি বাণিজ্যের অভিযোগ আপনার বিরুদ্ধেই।’ জবাবে কলিমউল্লাহ বলেন, ‘নো। নেভার, নেভার। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি এসব অপবাদ ছড়িয়েছেন।’
এ সময় দুদক প্রসিকিউটর দেলোয়ার জাহান রুমি বলেন, ‘উনি ১৭ ঘণ্টা কাজ করেছেন। আমরা তো তাকে টকশোতে দেখেছি। তখন কলিমউল্লাহ উত্তর দেন, সেটা তো রাতে।’
পরে বিচারক দুদক প্রসিকিউটরের কাছে জানতে চান— ‘তার বিরুদ্ধে অন্য মামলা আছে কি না?’ আদালতকে দুদক জানায়, ‘এই মামলায় আছে। এখন নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগের তদন্ত শুরু হবে।’ সে সময় দুদকের উদ্দেশ্যে বিচারক বলেন, ‘অভিযোগ আগে তদন্ত হোক।’
কলিমউল্লাহর উদ্দেশ্যে আদালত বলেন, ‘আপনি কী করেছেন, সেটা আলিমুল গায়েব জানেন আর আপনি জানেন। কিছুদিন পর দুদক জানবে। এরপর মানুষ জানবে।’
তখন কলিমউল্লাহ বলেন, ‘গত মাসের ১৮ তারিখে মামলার বিষয়টি ব্রিফিংয়ে জানানো হয়। আমি ভেবেছিলাম, দুদক থেকে আমাকে তলব করা হবে। আজ সকালে আকস্মিকভাবে নাস্তার পর ডিবি পুলিশ আমাকে গ্রেপ্তার করে। আপত্তি করিনি।’
পরে বিচারক বলেন, ‘আপনি আপত্তি করবেন কেন? কবরেও একা যেতে হবে, জেলখানায়ও একা যেতে হয়। কেউ সঙ্গে যায় না। দুর্নীতি যারা করছেন তারা জেলে পচছেন। আর দুর্নীতির টাকায় তার আত্মীয়রা অনেকে বিলাসি জীবনযাপন করছেন, বিদেশ ভ্রমণ করছেন।’
এরপর কলিমউল্লাহ বলেন, ‘মাননীয় আদালত, বেয়াদবি না নিলে একটা কথা বলি। আমি একজন কমিশন্ড অফিসার, গ্রেড-১ অফিসার।’ তখন বিচারক বলেন, ‘আপাতত আপনাকে জেলে যেতে হচ্ছে। আর জেল কোড ও আপনার অবস্থান অনুযায়ী ট্রিটমেন্ট পাবেন, সেটা আমি আদেশ দিচ্ছি।’ পরে আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।