১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের পাতায় লেখা সেই প্রতীকী আহ্বান— “আসছে ফাগুন, আমরা হবো দ্বিগুণ”, পুনরাবৃত্তি ঘটে ২০২৪ সালের জুলাইয়ে—তবে এবার বাস্তবে, রক্তে-ঘামে আর চূড়ান্ত বিজয়ের মাধ্যমে। বৈষম্যের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের ক্ষোভ, কোটা সংস্কার আন্দোলনের নতুন রূপ, ছাত্র-জনতার ঐক্য আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে অদম্য প্রতিরোধ—সব মিলিয়ে এ সময় গড়ে ওঠে এক অভূতপূর্ব গণআন্দোলন, যার কেন্দ্রে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
আন্দোলনের সূচনা:
১ জুলাই ২০২৪, সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের পুরোনো সিদ্ধান্ত বাতিল করে তা পুনর্বহাল করতে একটি পরিপত্র জারি হয়। এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমে আসেন।
‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানারে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে শুরু হয় অবস্থান। স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে পুরো এলাকা—
“কোটা না মেধা, মেধা মেধা”।
মিছিল গিয়ে ঠেকে রাজু ভাস্কর্যে, সেখান থেকেই ঘোষণা আসে তিন দিনের কর্মসূচির। ২ জুলাই থেকে ৪ জুলাই পর্যন্ত বর্জন করা হয় ক্লাস-পরীক্ষা। শিক্ষার্থীরা জানান, ২০১৮ সালের পরিপত্র পুনর্বহাল করে সেটিকে আইনে পরিণত করতে হবে। শুধু প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণি নয়—সব গ্রেডে কোটার সংস্কার চাই।
‘বাংলা ব্লকেড’ ও দেশব্যাপী বিস্তার:
৬ জুলাই ঘোষণা হয় ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি। ঢাবির আগুন ছড়িয়ে পড়ে জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম, জগন্নাথ, বরিশাল, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে।
শিক্ষার্থীরা একযোগে রাস্তায় নেমে আসে, বন্ধ করে দেয় যোগাযোগ ব্যবস্থা, অচল হয়ে পড়ে নগরজীবন।
প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য ও বিক্ষোভের তীব্রতা:
৭ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনকে ‘অযৌক্তিক’ বলেন এবং উল্লেখ করেন—
“বিষয়টি সর্বোচ্চ আদালতে নিষ্পত্তি হওয়া উচিত।”
এই মন্তব্য আরও ঘি ঢালে আগুনে। শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ আরও ছড়িয়ে দেন, সড়ক অবরোধ করে কার্যত রাজধানীর সঙ্গে অন্যান্য জেলার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
স্মারকলিপি ও বিতর্কিত মন্তব্যের পর আন্দোলনের মোড়:
১৪ জুলাই রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দিতে শিক্ষার্থীরা গণপদযাত্রা করেন। সেদিন সন্ধ্যায় প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন:
“কোটা মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরা পাবে না, তো কি রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে?”
এই বক্তব্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে জ্বালিয়ে তোলে। হলে হলে ধ্বনিত হয়:
“তুমি কে আমি কে—রাজাকার রাজাকার!”
“কে বলেছে কে বলেছে—স্বৈরাচার স্বৈরাচার!”
হামলা, সংঘর্ষ ও প্রাণহানি:
১৪ জুলাই রাতেই ছাত্রলীগ ও ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায়। আহতদের উপর হামলা চলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভেতরে-বাইরেও।
১৬ জুলাই চট্টগ্রাম, রংপুর ও ঢাকায় পুলিশ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের সঙ্গে সংঘর্ষে কমপক্ষে ছয়জন শিক্ষার্থী নিহত হন।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদের পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তীব্র ক্ষোভ ছড়ায় সারা দেশে।
সরকার অনির্দিষ্টকালের জন্য সব বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ বন্ধ ঘোষণা করে এবং শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেয়। শিক্ষার্থীরা তখন হলগুলো ছাত্রলীগের দখলমুক্ত করেন।
অসহযোগ আন্দোলনের সূচনা:
১৭ জুলাই গায়েবানা জানাজা করতে গিয়ে পুলিশের লাঠিচার্জের শিকার হন শিক্ষার্থীরা। জাহাঙ্গীরনগর ও রাজশাহীতেও একই চিত্র। প্রতিবাদে ঘোষণা আসে—
‘কমপ্লিট শাটডাউন’, হাসপাতাল ও জরুরি সেবা ব্যতীত সবকিছু বন্ধ।
১৮ থেকে ২৭ জুলাই পর্যন্ত ছিল:
- সেনা মোতায়েন
- কারফিউ
- অপহরণ করে নির্যাতন
- ‘ব্লক রেইড’
- মৃত্যুর মিছিল
তবুও থেমে থাকেনি ছাত্র-জনতা।
৩ আগস্ট শহীদ মিনার থেকে আসে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা—
“অসহযোগ আন্দোলন শুরু”।
রাজধানীতে লাখো মানুষ সমবেত হন।
গণঅভ্যুত্থান ও বিজয়ের দিন:
ঘোষণা ছিল ৬ আগস্ট, তবে পরিবর্তন করে ৫ আগস্টই ‘মার্চ টু ঢাকা’ পালন করা হয়।
সকাল থেকে ঢাকাজুড়ে থমথমে পরিবেশ। ১১টার দিকে রাস্তায় নেমে আসেন হাজারো ছাত্র-জনতা। শুরু হয় গণঅভ্যুত্থান।
একপর্যায়ে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেন এবং ভারতে পালিয়ে যান। বিক্ষুব্ধ জনতা ও শিক্ষার্থীরা গণভবন ও সংসদ ভবন দখলে নেন।
স্বৈরাচারের পতন হয়, গড়ে ওঠে এক নতুন নির্বাচিত ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ।
আন্দোলনকারীদের বক্তব্য:
মিফতাহুল হোসাইন আল মারুফ, ঢাবি ছাত্রশিবিরের সাহিত্য ও ক্রীড়া সম্পাদক বলেন:
“ভাইয়েরা শহীদ হওয়ার পর আন্দোলন আর কোটা ইস্যুতে সীমাবদ্ধ থাকেনি। মানুষের মনে বপন হয় গণঅভ্যুত্থানের বীজ। পতন ঘটে ফ্যাসিবাদ শেখ হাসিনার।”
মোসাদ্দেক আলী ইবনে মোহাম্মদ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সহ-সমন্বয়ক বলেন:
“বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মলগ্ন থেকেই গণআন্দোলনের সূচনা হয় এখান থেকেই। ২০২৪-এর বিদ্রোহও সেই ধারারই অংশ। ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা সত্ত্বেও ঢাকায় অবস্থান নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে গেছেন শিক্ষার্থীরা। এটি ছিল সম্মিলিত ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক বিজয়।”
পলিচটক্স/মি