সোশ্যাল মিডিয়া—আজকের দিনে এই শব্দ দু’টি শুধু প্রযুক্তির অংশ নয়, জীবনেরই অংশ হয়ে উঠেছে। অথচ বিশ বছর আগেও এটি ছিল অনেকটাই অপরিচিত এক নাম। তখন ইন্টারনেট ছিল ধীর, মোবাইল ফোন ছিল সীমিত, আর ‘বন্ধু খোঁজা’ মানেই ছিল অরকুটে গিয়ে স্ক্র্যাপ লেখার আনন্দ।

২০০৪ সালে গুগলের তৈরি করা অরকুট ছিল অনেকের ডিজিটাল সামাজিকতার প্রথম জানালা। প্রোফাইল সাজানো, ফটো আপলোড, কমিউনিটিতে যুক্ত হওয়া—সবই ছিল একধরনের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। কিন্তু অরকুটের সরলতা পেরিয়ে যখন আসে ফেসবুক, তখন বদলে যেতে থাকে অনলাইন সম্পর্কের সংজ্ঞা।

হার্ভার্ডের ছাত্র মার্ক জুকারবার্গের হাত ধরে জন্ম নেওয়া ফেসবুক দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের আনাচে-কানাচে। এটি শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, হয়ে ওঠে আত্মপ্রকাশের একটি বড় প্ল্যাটফর্ম। ফেসবুকের টাইমলাইন, স্ট্যাটাস, ছবি, ভিডিও, আর ‘পোক’—এসব ছিল এক ধরনের ভার্চুয়াল ঘনিষ্ঠতা গড়ার হাতিয়ার।

পরে একে একে আসে ইউটিউব (২০০৫), টুইটার (২০০6), ইনস্টাগ্রাম (২০১০)। ইউটিউব বদলে দেয় ভিডিওর সংজ্ঞা, যেখানে সাধারণ মানুষও হয়ে ওঠে তারকা। ইনস্টাগ্রাম এনে দেয় নতুন ভিজ্যুয়াল সংস্কৃতি—ছবি আর ক্যাপশনের মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করার এক অনন্য সুযোগ।

বন্ধুত্ব থেকে বাণিজ্য: সোশ্যাল মিডিয়ার বিবর্তন

২০১৪ থেকে ২০২৪—এই এক দশকে সোশ্যাল মিডিয়ার মুখোমুখি হয় এক আমূল পরিবর্তনের। যখন হাতে এসে যায় স্মার্টফোন, এবং ইন্টারনেট হয়ে পড়ে আরও দ্রুতগামী, তখনই শুরু হয় সোশ্যাল মিডিয়ার বাণিজ্যিক রূপান্তর।

ফেসবুক পেজ, ইনস্টাগ্রাম শপ, ইউটিউব মনেটাইজেশন, টিকটক মার্কেটিং—সব মিলিয়ে সামাজিক যোগাযোগের এই মাধ্যমগুলো হয়ে ওঠে ব্যক্তিগত ব্র্যান্ড তৈরির প্ল্যাটফর্ম। একসময় যে ছেলেটি বন্ধু খুঁজতে ফেসবুক চালাত, সে এখন একই প্ল্যাটফর্মে পণ্য বিক্রি করে আয় করছে। যে মেয়েটি ইনস্টাগ্রামে ফ্যাশন দেখে সময় কাটাত, সে এখন ফ্যাশন ইনফ্লুয়েন্সার।

ফলোয়ার সংখ্যাও এখন আর শুধু সৌজন্য নয়, এটি একটি মূলধন। পোস্টের ক্যাপশন, ছবির অ্যাঙ্গেল, হ্যাশট্যাগ—সবই এখন অ্যালগরিদম বুঝে কনটেন্ট সাজানোর কৌশল।

নতুন প্ল্যাটফর্ম, নতুন চ্যালেঞ্জ

২০২২ সালে যখন ইলন মাস্ক টুইটার অধিগ্রহণ করে একে রিব্র্যান্ড করে ‘X’ নাম দেন, তখন পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে মেটা নিয়ে আসে ‘থ্রেডস’। ইনস্টাগ্রামের সঙ্গে যুক্ত এই টেক্সটভিত্তিক অ্যাপটি ব্যবহারকারীদের আরও খোলামেলা মত প্রকাশের সুযোগ দেয়।

তবে এত প্রযুক্তিগত উন্নতির পাশাপাশি জন্ম নিয়েছে কিছু অন্ধকার দিকও। ভুয়া জীবনধারার প্রতিযোগিতা, নিজের জীবনের সঙ্গে অন্যের তুলনায় মনখারাপ, সাইবার বুলিং, ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তাহীনতা—এসবও এখন বাস্তব চ্যালেঞ্জ। অনেকেই ভুলে যাচ্ছেন কোনটা বাস্তব, আর কোনটা সাজানো।

আমরাই কি সোশ্যাল মিডিয়াকে চালাচ্ছি, নাকি সে-ই আমাদের?

আজকের সোশ্যাল মিডিয়া আর শুধুই বন্ধু খোঁজার জায়গা নয়; এটি এখন অর্থনীতি, মনস্তত্ত্ব, পরিচয় আর ব্যক্তিত্ব প্রকাশের এক জটিল প্ল্যাটফর্ম। ব্যক্তিগত আবেগ থেকে পেশাগত আয়—সবই এখন এই ভার্চুয়াল দুনিয়ার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

বিশ্ব সোশ্যাল মিডিয়া দিবসে দাঁড়িয়ে আমরা নতুন করে ভাবতে পারি—এই প্রযুক্তি কি আমাদের সহায়ক, নাকি আমরা তার নিয়ন্ত্রণে? যন্ত্রকে আমরা ব্যবহার করবো, না যন্ত্রই আমাদের চালাবে?

পলিটিক্স/মি

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version