গাজায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের চলমান দমন-পীড়ন ও সম্ভাব্য গণহত্যায় সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ।
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক বিশেষ র্যাপোর্টিয়ার ফ্রানচেসকা আলবানিজ এই প্রতিবেদন তৈরি করেছেন, যা আগামী বৃহস্পতিবার (৩ জুলাই) জেনেভায় উপস্থাপন করা হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব কোম্পানি সরাসরি বা পরোক্ষভাবে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে ইসরায়েলের দখলদার নীতিকে সহায়তা করছে। এদের কার্যক্রম এখন ‘গণহত্যার অর্থনীতি’র অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অভিযুক্ত কোম্পানির তালিকায় গুগল, মাইক্রোসফট, অ্যামাজনসহ ৪৮ প্রতিষ্ঠান
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি জায়ান্ট মাইক্রোসফট, গুগলের মূল প্রতিষ্ঠান অ্যালফাবেট ইনক, এবং অ্যামাজন ইসরায়েলকে তাদের ক্লাউড ও এআইভিত্তিক প্রযুক্তির পূর্ণাঙ্গ সরকারি ব্যবহার নিশ্চিত করেছে।
এছাড়া আইবিএম ইসরায়েলি সামরিক ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সহায়তা করছে।
পালান্টির টেকনোলজিসের ভূমিকা ভয়াবহ
মার্কিন সফটওয়্যার কোম্পানি পালান্টির টেকনোলজিস যুদ্ধের সময় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছে।
তারা “ল্যাভেন্ডার”, “গসপেল” ও “হোয়ার ইজ ড্যাডি” নামক এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে হামলার লক্ষ্য নির্ধারণ করছে, যা কার্যত মানুষের জীবন-মৃত্যুর ফয়সালা করছে কম্পিউটারের সিদ্ধান্তে।
দ্বৈত-ব্যবহারযোগ্য প্রযুক্তির অপব্যবহার
অনেক বেসামরিক প্রযুক্তিও সামরিক দখলদারত্বে ব্যবহৃত হচ্ছে। যেমন:
- ক্যাটারপিলার, ভলভো, এইচডি হুন্দাই সরবরাহ করছে এমন ভারী যন্ত্রপাতি যা পশ্চিম তীরে ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেয়।
- রাডা ইলেকট্রনিক ইন্ডাস্ট্রিজ ইসরায়েলের সামরিক প্রযুক্তির জোগানদাতা।
- বুকিং ডট কম ও এয়ারবিএনবি অবৈধ বসতিতে ঘরভাড়া দিয়ে দখলদারতাকে স্বীকৃতি দিচ্ছে।
কৃষি ও জ্বালানি খাতেও সহায়তা
- ব্রাইট ডেইরি অ্যান্ড ফুড ফিলিস্তিনি জমিতে স্থাপিত ইসরায়েলি অবৈধ স্থাপনায় মুনাফা করে।
- নেটাফিম পশ্চিম তীরে পানি উত্তোলন প্রযুক্তি দিয়ে সহায়তা করছে।
- ড্রামন্ড কোম্পানি ও গ্লেনকোর সরবরাহ করছে কয়লা, যা ইসরায়েলের বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়।
ব্যাংক ও বিনিয়োগ সংস্থার অর্থায়ন
- ব্ল্যাকরক ও ভ্যানগার্ড—দুই বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইসরায়েলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক অর্থ বিনিয়োগ করেছে।
- ব্ল্যাকরক: পালান্টিরে ৮.৬%, মাইক্রোসফটে ৭.৮%, অ্যামাজনে ৬.৬%।
- ভ্যানগার্ড: ক্যাটারপিলারে ৯.৮%, এলবিট সিস্টেমসে ২%।
- বিএনপি পারিবাস, বার্কলেসসহ বহু ব্যাংক ইসরায়েলকে ঋণ দিয়ে যুদ্ধকালীন সময়ে সুদের হার কম রাখতে সহায়তা করছে।
শেয়ারবাজারে লভ্যাংশের উল্লম্ফন
ইসরায়েলের অস্ত্র ও প্রযুক্তি কোম্পানির শেয়ারমূল্য রেকর্ড হারে বেড়েছে।
তেলআবিব স্টক এক্সচেঞ্জে ১৭৯ শতাংশ বৃদ্ধির মাধ্যমে বাজারমূল্য দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৭৯০ কোটি ডলারে, যা যুদ্ধকালীন সময়ে কর্পোরেট মুনাফার ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে।
মানবিক দায়বদ্ধতার বদলে ‘হিউম্যানিটারিয়ান-ওয়াশিং’
২০১৮ সালে সাময়িকভাবে অবৈধ বসতির তালিকা সরিয়ে নিলেও, এয়ারবিএনবি তা আবার চালু করে, ‘মানবিক কাজে আয় দান’ করার অজুহাতে।
জাতিসংঘ একে ‘হিউম্যানিটারিয়ান-ওয়াশিং’ হিসেবে উল্লেখ করেছে।
কর্পোরেট অপরাধের দায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে
প্রতিবেদন বলছে, কর্পোরেট সংস্থাগুলো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন মেনে চলতে বাধ্য।
ব্যবসায়িক সম্পর্কের মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত হলে, সেটিও আন্তর্জাতিক অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
এমনকি কোনো কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তাও বিচারের মুখোমুখি হতে পারেন।
আইসিজের রায় ও জাতিসংঘের আহ্বান
২০২৪ সালের জুলাইয়ে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) রায়ে জানায়, পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে ইসরায়েলের দখলদারত্ব অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত।
জাতিসংঘ ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে দখলদার কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে।
দখলদার অর্থনীতি: ‘ঔপনিবেশিক বর্ণবাদী পুঁজিবাদ’
আলবানিজের প্রতিবেদনে ইসরায়েলের দখলদারতাকে “ঔপনিবেশিক বর্ণবাদী পুঁজিবাদ” হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
এটি এখন বহু আন্তর্জাতিক কর্পোরেশনকে লাভবান করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রতিবেদন কর্পোরেট জগতকে নৈতিক ও আইনি দায়বদ্ধতার এক বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করেছে।