হজ—ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম। এটি শুধু একটি ইবাদতই নয়, বরং একজন মুসলমানের আত্মশুদ্ধির সর্বোচ্চ সুযোগ। হজ মানুষের জীবনে একবার ফরজ হয়—যখন সে শারীরিক, মানসিক ও আর্থিকভাবে সক্ষম হয়। কিন্তু হজ আদায় করতে হলে চাই যথাযথ প্রস্তুতি ও সঠিক নিয়ম জানা। শুধু সৌদি আরবে গিয়ে কিছু কাজ করলেই হজ হয় না—হজের পূর্বপ্রস্তুতি থেকে শুরু করে প্রতিটি স্তরে ইসলামী শরিয়তের নির্দেশনা মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি।

🕋 হজের পূর্বপ্রস্তুতি

১. নিয়ত বিশুদ্ধ করা

হজের প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তুতি হলো, এর পেছনের উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা। লোক দেখানো, নামের আগে “হাজি” লেখার বাসনা বা সামাজিক মর্যাদার জন্য হজ নয়—এটি শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হতে হবে। রাসুল (সা.) বলেন:

“সমস্ত আমলই নিয়তের ওপর নির্ভর করে।” (সহিহ বুখারি)

২. হালাল অর্থ দ্বারা হজের খরচ জোগাড়

কোরআনে আল্লাহ বলেন:

“নিশ্চয়ই আল্লাহ শুধু পরহেজগারদের পক্ষ থেকেই (কোরবানি ও আমল) গ্রহণ করেন।” (সূরা মায়িদা: ২৭)
হজের জন্য ব্যবহৃত অর্থ যদি হারাম হয়, তবে হজ কবুল হবে না।

৩. হজের মাসাইল ও বিধি-বিধান শেখা

হজ অত্যন্ত সংবেদনশীল ও নির্দিষ্ট নিয়মে সম্পাদনযোগ্য ইবাদত। তাই হজে যাওয়ার আগে একজন আলেম বা নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে হজের ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত ও মুস্তাহাব বিষয়গুলো ভালোভাবে জেনে নেওয়া জরুরি।

৪. অপরাধ মুক্ত ও ক্ষমা প্রার্থনা করা

হজের আগে আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী, বন্ধু–পরিজনের সঙ্গে দুঃখ ভোলা, ক্ষমা চাওয়া ও ক্ষতিপূরণ করা উচিত। হজের সফলতার জন্য পবিত্র অন্তর ও নিষ্কলুষ সম্পর্ক অপরিহার্য।

৫. শারীরিক প্রস্তুতি

হজ একটি শারীরিক পরিশ্রমের ইবাদত। দীর্ঘ হাটা, ভিড় সামলানো, গরম ও ধূলাবালুতে সহনশীল হওয়া দরকার। তাই হজে যাওয়ার আগেই হাঁটার অভ্যাস ও স্বাস্থ্য রুটিন ঠিক করা দরকার।

🕌 হজের ধাপে ধাপে নিয়ম

প্রথম ধাপ: ইহরাম

  • ইহরাম হলো হজ শুরুর পোশাক ও নিয়ত।
  • ইহরাম বাঁধার সময় দুই রাকাত নামাজ আদায় করে নিয়ত করতে হয়—“লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা হজ্জান”
  • এরপর তালবিয়া পড়তে হয়:

“লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারীকা লাকা লাব্বাইক…”

দ্বিতীয় ধাপ: মক্কায় পৌঁছে তাওয়াফ কুদুম

  • কাবাঘরের চারপাশে সাতবার ঘোরা—এটাই তাওয়াফ।
  • এরপর দুই রাকাত নামাজ আদায় করে জমজম পানি পান করা।

তৃতীয় ধাপ: সাঈ (সাফা-মারওয়ার মাঝখানে সাতবার দৌড়ানো)

  • হজে তামাত্তু করলে উমরার অংশ হিসেবে সাঈ করতে হয় এবং মাথার চুল কেটে ইহরাম খোলা যায়।
  • হজে কিরান বা ইফরাদ করলে হজের সময়ই সাঈ করতে হয়।

চতুর্থ ধাপ: ৮ জিলহজ (ইয়াওমুত তারওয়িয়া)

  • পুনরায় ইহরাম বাঁধা।
  • মিনায় যাওয়া ও রাত যাপন।

পঞ্চম ধাপ: ৯ জিলহজ (আরাফাহ দিবস)

  • আরাফার ময়দানে অবস্থান ও খুতবা শোনা।
  • এটি হজের মূল রুকন। রাসুল (সা.) বলেন: “হজ হচ্ছে আরাফা।”
  • এরপর সূর্যাস্তের পর মুযদালিফায় যাত্রা।

ষষ্ঠ ধাপ: ১০ জিলহজ (ঈদের দিন)

  • জামারাতুল উকবা (বড় শয়তান)–এ পাথর নিক্ষেপ।
  • পশু কোরবানি করা।
  • মাথা মুন্ডন বা চুল ছাঁটা।
  • এরপর ইহরাম খোলা ও সাধারণ পোশাক পরিধান।

সপ্তম ধাপ: তাওয়াফে জিয়ারা (ফরজ)

  • কাবা শরিফের তাওয়াফ করা এবং সাঈ (যদি আগে না করা হয়)।
  • এটি হজের ফরজ অংশ।

অষ্টম ধাপ: ১১–১২ জিলহজ

  • মিনায় অবস্থান করা এবং তিনটি জামারায় (শয়তান) সাতটি করে মোট ২১টি পাথর নিক্ষেপ করা।

নবম ধাপ: বিদায়ী তাওয়াফ (তাওয়াফে বিদা)

  • হজ শেষে মক্কা ত্যাগের আগে এটি করাই সুন্নত।

💡 কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ

  • সব সময় ধৈর্য ও নম্রতা বজায় রাখা।
  • দলছুট না হওয়া, পরিচয়পত্র বহন করা।
  • মহিলাদের জন্য শরিয়তের পর্দা মেনে চলা আবশ্যক।
  • সব কাজে আল্লাহর উপর ভরসা ও দোয়ার মাধ্যমে নিজেকে পরিচালনা করা। 🤲 শেষ কথা

হজ মানে আত্মাকে পবিত্র করা, আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের প্রচেষ্টা এবং জীবনের পাপরাশিকে ধুয়ে ফেলা। হজ শুধু একটি সফর নয়—এটি আত্মার জাগরণ, চরিত্রের সংশোধন এবং আল্লাহর প্রেমে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার এক মহান উপলক্ষ। আল্লাহ তাআলা যেন আমাদের সবাইকে হালাল সম্পদ, বিশুদ্ধ নিয়ত ও শরিয়তের পদ্ধতিতে হজ আদায় করার তাওফিক দেন। আমিন।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version